মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৭:১৬ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বাংলাদেশের গরু খামারিদের জন্য আশীর্বাদ মোদি সরকার!

বাংলাদেশের গরু খামারিদের জন্য আশীর্বাদ মোদি সরকার!

স্বদেশ ডেস্ক:

বছর দেড়েক আগে ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় ১২ থেকে ১৫টি গরু নিয়ে খামার শুরু করেছিলেন তাসনীম আহমেদ। বর্তমানে তার খামারে গরুর সংখ্যা ৪০টির মতো। আগে তিনি অন্য ব্যবসা করতেন, এখনো করেন। তবে নতুন করে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন গরু পালনে।

ইদানীং কৃষি, বিশেষ করে পশুর খামারের ব্যবসাটি ‘বুমিং’ হওয়ার কারণেই এই খামারটি শুরু করেন তিনি, বিবিসি বাংলাকে জানালেন মিস্টার আহমেদ।

‘গত বছর ৩৫টির মতো গরু কিনেছিলাম কোরবানির বাজারের জন্য। যার ২৯টি এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন বিক্রির জন্য আছে আর ৬টি।’ তাসনীম আহমেদের মতো এখন অনেকেই ঝুঁকছেন গরুর খামার করার দিকে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণরা আসছেন এই ব্যবসায়। আর এর কারণ হলো বাজারে স্থানীয়ভাবে লালন-পালন করা পশুর বিপুল চাহিদা।

ঈদুল আযহার সময় বাংলাদেশে যত পশু কোরবানী হয়, এক সময় তার একটা বড় অংশ আসতো ভারত থেকে। কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু চোরাচালান বন্ধ করতে ওই দেশের কর্তৃপক্ষ বেশ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

শুরুতে বাংলাদেশের ভোক্তারা খানিকটা সমস্যায় পড়লেও অনেকে একটি সুযোগ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। নতুন অনেক উদ্যোক্তা শুরু করেন গরুর খামার। ফলে খুব দ্রুতই পাল্টে যায় বাংলাদেশে পশু পালনের চিত্রটি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, গত তিন চার বছর ধরে কোরবানির জন্য দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়েই মূলত চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে একটা নির্দেশনা আছে যে, তাদের দেশ থেকে যাতে কোন পশু বাইরে না যায়। এটা আমাদের জন্যও খুবই ভালো। আমাদের ভেটেনারি মেডিকেল টিম রয়েছে যারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। তারাও বলেছে যে, ভারতীয় গরু এখনো তেমন চোখে পড়েনি।’

কী পরিমাণ গরু আসছে ভারত থেকে?

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি’র দেয়া তথ্য উল্লেখ করে খালেদুজ্জামান বলেন, ২০১৩ সালে গরুর করিডোরের মাধ্যমে গরু আসে ২৩ লাখ, ২০১৪ সালে এসেছে ২১ লাখ। আর ২০১৫ সালে আসে ১৬ লাখ এবং ২০১৬ সালে ১১ লাখ।

তিনি জানান, এর পরের বছর সংখ্যাটা দশ লাখের নিচে নেমে আসে। ওই বছর গরু আসে ৯ লাখ। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল সাত লাখ।

চলতি বছরে এই সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। খালেদুজ্জামান বলেন, এ বছর বৈধ পথে এসেছে মাত্র ৯২ হাজার গরু। ‘বছর শেষে আরো কিছু আসতে পারে, তবে আগের তুলনায় সংখ্যাটা বেশ কমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা নির্দেশ করে যে, দেশীয় উৎস বাড়ছে, আমরা সরবরাহ করছি এবং বাইরে থেকে আসাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানাচ্ছে যে এবারে কোরবানীর জন্য গরু-মহিষ পাওয়া যাবে সংখ্যা ৪৫ লাখ ৮২ হাজারটি, আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কোরবানির জন্য প্রস্তুত এক কোটি ১৭ লাখ পশু।

দেশীয় বাজারে চাহিদা নির্ধারণ করা হয় গত বছর যত পশু জবাই করা হয় তার সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করে। সে হিসেবে, গত বছর জবাই করা এক কোটি পাঁচ লাখের সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করে এবারে চাহিদা ধরা হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা খালেদুজ্জামান জানান, দেশীয় উৎপাদন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর পরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক করে বিজিবিকে অনুরোধ করে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

দাম কেমন হবে?

চাহিদার তুলনায় গরুর উৎপাদন বেশি থাকায় এটা দামের উপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের বাইরে থেকে, বিশেষ করে ভারত থেকে পশু আসার তেমন কোন খবর পাওয়া যায়নি, আর উৎপাদন ও চাহিদায় যে পার্থক্য আছে সেটা তেমন বড় নয়, তাই আশা করা যায় যে এটা দামের উপর তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না।

খালেদুজ্জামান বলেন, বিদেশি গরু আসা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের খামারিদের ব্যবসায় বড় ধরণের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, অনেক তরুণ-তরুণী এই খামারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।

ঈদুল আযহার সময়ে চামড়া শিল্প বাদে শুধু গবাদি পশু খাতেই টার্ন ওভারের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। খালেদুজ্জামান বলেন, এটা খুবই ইতিবাচক, কারণ একদিকে যেমন দেশীয় উৎস থেকে দেশের মানুষকে নিরাপদ মাংস সরবরাহ করা যাচ্ছে, তেমনি বাইরে থেকে গরুর সাথে আসা নানা ধরণের রোগব্যাধিও কমে গেছে।

ট্রান্স-বাউন্ডারি অ্যানিম্যাল ডিজিজ অর্থাৎ পশুর মাধ্যমে যেসব রোগ এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়-যেমন গরুর খুরা রোগ, অ্যান্থ্রাক্স ইত্যাদি – সেগুলোও কম দেখা যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, নিরাপদ মাংস উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশীয় বাজার সৃষ্টিতে স্থানীয়ভাবে গরুর উৎপাদন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, প্রতিবছরই খামার নিবন্ধনের আওতায় খামারিদের সংখ্যা হিসাব করা হয়। এই হিসাব অনুযায়ী, এবছর খামারির সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার।

খালেদুজ্জামান বলেন, ‘এক বছরেই খামারির সংখ্যা এক লাখের উপরে বেড়ে গেছে। তবে এই খামারিদের মধ্যে ডেইরি খামারও রয়েছে।’

পশু খামারিদের ভবিষ্যৎ কী?

২০১৭ সালের হিসাবে, প্রোটিনের চাহিদা পূরণে মাছের পাশাপাশি জনপ্রতি প্রতিদিন ১২০ গ্রাম হারে মাংস খেলে সেটাকে মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে ধরা হয়। সে হিসেবে গত বছর চাহিদার ৭২ লাখ মেট্রিক টন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এবার এই চাহিদা ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ মেট্রিক টন।

‘তবে এই চাহিদা ভবিষ্যতে বেড়ে ১৫০ গ্রাম বা ২০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এটা হলো দেশীয় বাজারে বৃদ্ধি,’ বলছেন এই কর্মকর্তা।

আর বিদেশি বাজার ধরতে এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাংস রপ্তানি শুরু করেছে বলে তিনি জানান। তবে এর জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।

অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে?

পশুপালনে এই পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখা শুরু করেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, এই খাতটি অর্থনীতির জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, তবে সেজন্য যথাযথ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘প্রায় সব সময়ই মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য আমরা ভারতের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন যদি এক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা যায়, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক।’

সায়মা হক বিদিশা আরও বলেন, সরকার যদি একে একটা শিল্প এবং একটা বড় খাত ধরে চিন্তা করে পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পশুপালন একদিকে দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

আর কী পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের?

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, ডেইরি ও বিফ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশে চার হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প রয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক জবাবইখানা নির্মাণ, যা নিরাপদ মাংসের জন্য প্রয়োজন। এছাড়া, গবাদি পশুর সুষম খাদ্য নিশ্চিতে এগুলোর আমদানি শুল্কমুক্ত করা, আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ, কসাই প্রশিক্ষণ, গবাদি পশু বীমা, মাংসের গুণাগুণ নিশ্চিতে মান নিয়ন্ত্রণ, ল্যাবরেটরি নির্মাণ, খামারিদের পশুপালন ঋণ দেয়ার মতো পরিকল্পনা রয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877